রাজাদের অন্দরমহলের চটি কাহিনী

মোগল ললনাগণ সম্রাটের হেরেমে তাদের গোটা জীবন অতিবাহিত করতেন। মোগল হেরেমের কথা শুনলে এখনো অনেকের শিরঃদাড়া ঠাণ্ডা হয়ে আসে এবং রহস্যের একটি বাতাবরণ তৈরি হয়। মোগল রমনীগণ সাধারণ ছিলেন না। 



তারা ছিলেন রাজকীয় মহিলা। তাই তাদের সামাজিক জীবন ছিল সাধারণ মহিলাদের চেয়ে আলাদা। মোগল রমনীদের জীবন যাপন, তাদের বাসস্থান, খাবার দাবার, পোশাক পরিচ্ছদ, বিনোদন, তাদের আনন্দ বেদনা ও শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। মোগল হেরেমের অধিকাংশ বর্ণনা দিয়েছেন ইউরোপীয় পর্যটকরা। তবে প্রাচ্য বিশেষ করে ইসলামের কঠোর পর্দা প্রথা এবং ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় তারা মোগল হেরেমকে কখনো তুলনা করেছেন কারাগারের সঙ্গে কখনো বা আস্তাবলের সঙ্গে। কখনো বা দেখা হয়েছে সম্রাটের যৌন বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে। কিন্তু তাদের ধারণা মোটেই ঠিক নয়। মোগল হেরেম সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দিয়েছেন হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম। তিনি তার লেখা জীবনীমূলক গ্রন্থ হুমায়ুননামায় এ বর্ণনা দিয়েছেন। সম্রাট বা শাহজাদাদের পুত্র সন্তানের মা হওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। হেরেমের মহিলারা বাইরের পৃথিবীর রাজনৈতিক পরির্বতন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতেন। মোগল হেরেমের মহিলারা হজে যেতেন। তারা পার্টি বা রাজসভায় যোগদান করতেন। হেরেম একটি আরবী শব্দ। এ শব্দের অর্থ হলো নিষিদ্ধ। মুসলিম রীতি অনুযায়ী মহিলাদের বাসস্থানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মহিলাদের গোপনীয়তা লংঘন করা হারাম। তাই মোগল রাজদরবারের মহিলাদের বাসস্থান হেরেম হিসাবে পরিচিত অর্জন করে। হেরেমকে মহল, জেনানা, হেরেম-সারা, হেরেম-গাঁ, মহল-সারা, রানীবাস ইত্যাদি নামেও আখ্যায়িত করা হতো।

ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় মহিলাদের মর্যাদা তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে যায়। পর্দা প্রথা চালু হওয়ায় মুসলিম মহিলারা চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। কন্যা শিশুর জন্মকে শুভ হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। তবে অভিজাত ও রাজপরিবারের মহিলারা অন্তঃপুরে অবস্থান করলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তুলনায় তারা উন্নততর জীবন যাপন করতেন। মহিলারা সুশিক্ষা লাভ করতেন এবং তারা তাদের মেধা বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পেতেন। কখনো কখনো তারা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেন। দিল্লি সালতানাতে সম্রাট ইলতুৎমিশের বুদ্ধিমতি কন্যা রাজিয়া সুলতানা ছিলেন ইলবারি সালতানাতের ইতিহাসে একমাত্র মহিলা শাসক। তার শাসনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও ছিল ঘটনাবহুল। অসীম সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। সুলতানি আমলে আরো কয়েকজন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খী মহিলার জন্ম হয়েছিল যাদের মধ্যে ছিলেন ইলতুৎমিশের স্ত্রী এবং রোকনউদ্দিন ফিরোজের মা শাহ তুর্কান, জালালউদ্দিন খিলজির সহধর্মিনী মালিকা-ই-জাহান, মোহাম্মদ তুঘলকের বোন খোদাবানজেদা, বাহালুল লোদির পাটরানী শামস খাতুন, বাহালুল লোদির হিন্দু সহধর্মিনী ও সিকান্দার লোদির মা আম্ভা বিবি প্রমুখ।

ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া থেকে মোগলরা ভারতে পদার্পন করে। মোগলদের আগমনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়। এসব উপাদান বিদ্যমান সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মোগলরা শুধু দেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন তাই নয়, তারা হিন্দুস্তানের গোটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক জগৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাদের প্রভাব এত ব্যাপক যে, শত শত বছর পরও স্মৃতিস্তম্ভ, মোগলাই রান্না, সোনালী ও রূপালী পাড়ের এম্ব্রোয়ডারি, জারদোজি, চিকনকরি এম্ব্রোয়ডারি, বেনারসে তৈরি বিখ্যাত সিল্কের কিম-খুওয়াব ব্রোকেড, কাশ্মীর, দিল্লি, লক্ষ্ণৌ ও অমৃতসরের স্যান্ডাল ও চামড়ার জুতা, বিকানারের চামড়ার পানির পাত্র, কাশ্মীরী শাল ও কার্পেট, ভারতীয় সঙ্গীত এবং সেতার, সরোদ, সাঙ্গারি, শানাই ও সান্তুরের মতো বাদ্যযন্ত্রে এখনো বিদ্যমান।

মোগল হেরেমে বহু মহিলা বসবাস করতেন। এসব মহিলা ছিলেন বিভিন্ন প্রদেশ, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের। কখনো কখনো মোগল হেরেমে মহিলাদের সংখ্যা হতো ২ হাজার। হেরেমে মুসলমান ছাড়াও হিন্দু রাজপুত এমনকি খ্রিস্টান মহিলাও ছিল। বাবর ও হুমায়ুনের হেরেম ছিল আকারে ছোট। তবে সম্রাট আকবরের আমল থেকে হেরেমের আয়তন বৃদ্ধি পায়। তার হেরেমে মহিলা ছিল ৫ হাজার। জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের হেরেমও ছিল বেশ বড়। ঐতিহাসিক হকিন্সের মতে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল তিন শত। তাদের মধ্যে চারজন ছিলেন প্রধান। ঐতিহাসিক টেরির মতে, জাহাঙ্গীরের হেরেমে ৪ জন স্ত্রী ছাড়াও ছিল উপপত্নী এবং আরো এক হাজার মহিলা।

হেরেমের কথা কল্পনা করলেই আমাদের মনে রানী, উপপত্মী, নর্তকী, গায়িকা ও দাসীর ছবি ভেসে উঠে। তবে এসব মহিলা ছাড়া আরো মহিলা হেরেমে অবস্থান করতেন। তারা ছিলেন সম্রাটের মা, সৎ মা, কন্যা, তার মহিলা আত্মীয় স্বজন। বড় হওয়া নাগাদ ছেলেরাও হেরেমে অবস্থান করতো। তাছাড়া ছিল সঙ্গিনী, দাসী, বাদী, মহিলা কর্মচারি ও প্রহরী। সম্রাট হেরেম দেখাশোনা করার জন্য তাদের নিয়োগ দিতেন। খোজা প্রহরীরা হেরেমের চারদিকে পাহারা দিতো। কয়েকজন মহিলা ও খোজা প্রহরী গুপ্তচর হিসাবে কাজ করতো। তারা হেরেমে অবস্থানকারী মহিলাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্রাটকে অবহিত করতো। বিয়ে, জন্ম, ক্রয়, নিয়োগ অথবা উপঢৌকনের মধ্য দিয়ে মহিলাদের হেরেমে ঠাঁই হতো।

মোগল আমল শুধু সম্রাট বা শাহজাদাদের নয়, এ আমল ছিল শাহজাদী, রানী ও হেরেমের সভ্রান্ত মহিলাদের অধ্যায়ও। মোগল পুরুষদের মতো মোগল মহিলারাও ছিলেন সমানভাবে খ্যাতনামা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহিলারা ছিলেন পুরুষদের চেয়ে বেশি অগ্রসর। এসব সুন্দরী, শিক্ষিতা ও অসম্ভব মেধাবী মহিলা শুধু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তা নয়, তারা সমসাময়িক রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব রেখেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অবগুণ্ঠন এবং মহলের চার দেয়ালে আবদ্ধ এসব মহিলার সাফল্য এত বেশি যে, তাদের কারো কারো অবদান আজকের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশে পরিণত হয়েছে।

জীবন যাপন প্রণালী

হেরেমে বসবাসকারী মহিলাদের কঠোর পর্দা মানতে হতো। নিজেদের ইচ্ছামতো বাইরে যাবার স্বাধীনতা তাদের ছিল না। তবে কখনো কখনো বাইরে গেলে তাদেরকে বোরখায় মুখ ঢেকে যেতে হতো। হেরেমের ভেতর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যেতো। তাদের বিলাস ব্যসনের কমতি ছিল না। উৎসব ও আনন্দে তাদের সময় কাটতো। ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার ও ইতালীয় চিকিৎসক ম্যানুয়েল মানুচির মতো বিদেশিরা মোগল হেরেমে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের মুখে হেরেমের এমন বর্ণনাই পাওয়া গেছে। বিশাল বিশাল এপার্টমেন্টে মহিলারা বসবাস করতেন। হেরেমে ছিল বিশাল বাগান, ঝরনা, পুকুর ও পানির ফোয়ারা। মহিলারা চোখ ধাঁধানো পোশাক পরতেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত অলঙ্কার পরতেন। হাতির পিঠে হাওদা অথবা পাল্কিতে চড়ে বাইরে যেতেন। রাজকীয় বিভাগগুলো সম্রাট ও হেরেমের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতো। মাতবাথ নামে পরিচিত পাকশালা থেকে তাদের খাবার পরিবেশন করা হতো। আকবরখানা খাবার পানি ও পানীয় সরবরাহ করতো। গ্রীষ্মকালে প্রাসাদে বরফ শীতল পানি পৌঁছে দেয়া হতো। মেওয়াখানা থেকে ফলমূল সরবরাহ করা হতো। রাজকীয় কারখানা থেকে মহিলাদের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, অলঙ্কার, সাধারণ ব্যবহার্য সামগ্রী ও বিনোদনমূলক দ্রবাদি প্রদান করা হতো।

 খাবার

মোগলরা ছিল ভোজন রসিক। তাদের খাবারের নাম ছিল মোগলাই। মেন্যুতে থাকতো বহু উন্নত ও সুস্বাদু খাদ্য। মোগল সম্রাট পাকশালার জন্য দৈনিক এক হাজার রুপি বরাদ্দ করতেন। পাকশালায় বিভিন্ন দেশের খাবার রান্না করা হতো। প্রতিদিন বহু লোভনীয় খাবার রান্না করা হতো। মোগলরা দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। দস্তরখানায় মাংস ছিল অপরিহার্য। কালিয়া ও কোরমা ছিল জনপ্রিয় খাবার। সম্রাট হেরেমে আহার করতেন। বিষ মেশানো আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দাস দাসীদের দিয়ে খাবার পরীক্ষা করিয়ে খেতেন। সম্রাটগণ বিশেষ ধরনের একটি প্লেটে খাবার খেতেন। খাদ্যে বিষ থাকলে প্লেটটি নীল রং ধারণ করতো। প্রতিবেলার সাধারণ আহারে থাকতো ৫০ থেকে একশো পদ। রাজকীয় ভোজে পদ থাকতো কয়েক শত। সম্রাট আকবর কোনো কোনো দিন গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে ১০৩ রকমের ডালের সঙ্গে টাটকা ফুলকো লুচি চাইতেন। সম্রাট শাহজাহানের জন্য বিশেষ ধরনের কোরমা পাক করা হতো। তার জন্য কোরমা তৈরিতে যে ব্যয় হতো তা বর্তমান বাজারে একজন ধনী লোকের এক মাসের বাজার খরচের সমান। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে, হেরেমের মহিলাদের সকাল থেকে খাবার গ্রহণের অনুমতি দেয়া হতো। রাত অবধি চলতো খাবার গ্রহণের পালা। মোগল মহিলাদের খাবারের মধ্যে থাকতো তাজা ও শুকনো ফলমূল। তারা বাদাম ও পান খেতেন। পান খেলে তাদের ঠোঁট ও দাঁত লাল হতো। তাকে সৌন্দর্যের অংশ বলে গণ্য করা হতো। অতিথিদের পান খেতে দেয়া হতো।

চিত্তবিনোদন ও অবসর

হেরেমের মহিলারা কদাচিৎ বাইরে যাবার সুযোগ পেতেন। তাই তাদের অধিকাংশ সময় কাটতো হেরেমের অভ্যন্তরে। হেরেমের স্টাফকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হতো। রাজকীয় মহিলারা নিজেদের সাজসজ্জা ও বেশভূষা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। গল্প গুজব করতেন। কেউ কেউ স্বর্ণ নির্মিত হায়দরাবাদি হুক্কা দিয়ে তামাক খেতেন। হেরেমে চিত্তবিনোদনের নানা আয়োজন করা হতো। গান ও নাচের জন্য মহিলা তত্ত্বাবধায়ক থাকতো। হেরেমে প্রচুর মহিলা গায়িকা ও নর্তকী ছিল। মহিলারা লুডু ও দাবার মতো নির্দোষ ঘরোয়া খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করতেন। বাইরে গিয়ে পলো খেলতেন। এমনকি ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন। তীর ছুঁড়তেন। হরেমের মহিলারা শিকারে যেতেন। হরিণ শিকার করা ছিল তাদের জন্য সহজ। একবার সম্রাট জাহাঙ্গীর স্ত্রীদের নিয়ে সামানগাঁয় হরিণ শিকারে যান। জঙ্গলের ৬৪১টি হরিণের মধ্যে ৮৪টির নাকে রুপার আংটি পরিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কয়েকটি হরিণ শিকার করা হয়। জাহাঙ্গীর এসব হরিণের মাংস তার বেগমদের মধ্যে বিতরণ করেন। সাহিত্যের প্রতি হেরেমের মহিলাদের ঝোঁক ছিল। তারা শেখ সাদীর গুলিসঁ্তা বোস্তাঁ কিংবা নাসির-ই-খসরুর দিওয়ান পাঠ করতেন। কোনো কোনো মহিলা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যেতেন এবং স্মৃতিস্তম্ভ ও বাগান নির্মাণের মতো ভারি কাজে যোগ দিতেন। তারা মানসম্পন্ন বই লিখতেন। ব্যবসা বাণিজ্য এবং সমকালীন রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করতেন।

মর্যাদা ও অবস্থান

সম্রাটকে কেন্দ্র করে মোগল হেরেমের মহিলাদের জীবন আবর্তিত হতো। হেরেমের সকল মহিলা সমান মর্যাদা ভোগ করতেন না। সম্রাটের জীবন ও হৃদয়ে যার যতটুকু স্থান ছিল তার ভিত্তিতে হেরেমে তাদের অবস্থান নির্ধারিত হতো। মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মধুর ও আন্তরিক। পারস্পরিক ঈর্ষাকাতরতা ছিল। তবে তার প্রকাশ ঘটতো সামান্য। প্রত্যেকে সাধ্যমতো সম্রাটকে তুষ্ট করার চেষ্টা করতেন। সম্রাটের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় প্রত্যেকে ঈর্ষাকাতরতা, ঝগড়াটে ও বদমেজাজ দেখানো থেকে বিরত থাকতেন। সম্রাট বা শাহজাদাকে প্রথমে একটি পুত্র সন্তান উপহার দেয়া অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হতো। মোগল রাজবংশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তান হতো তার উত্তরাধিকারী। এ লোভ কোনো রানী সংবরণ করতে পারতেন না। প্রত্যেকেই তার নিজের পুত্রকে মোগল রাজবংশের উত্তরাধিকারী হিসাবে দেখতে চাইতেন। এ আকাঙ্খা থেকে পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ দেখা দিতো। এমনকি প্রতারণার মতো ঘটনাও ঘটতো। একজন অন্যজনের গর্ভপাত ঘটানোর ফন্দি আঁটতেন। শায়েস্তা খানের স্ত্রী ৮ জন মহিলার গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন যাতে তার পুত্র ছাড়া আর কোনো মহিলার সন্তান জীবিত না থাকে। এক মহিলা ভুয়া অন্তঃসত্ত্বা সেজে হুমায়ুনকে ১১ মাস ফাঁকি দিয়েছিল। তাদের উদ্বেগ ও অসন্তুষ্টি সাধারণত গোপন রাখা হতো। মহিলাদের মৃত্যু সংবাদ প্রাসাদে খুব একটা প্রচার করা হতো না। কোনো মহিলা অসুস্থ হলে তাকে বিমারখানায় স্থানান্তর করা হতো। হেরেমের সুপরিচিত মহিলাদের মৃত্যুতে শোক পালন করা হতো।

যে মহিলার অবস্থান যত গুরুত্বপূর্ণ হতো তিনি তত বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। নিঃসন্তান হলে তাকে অন্য মহিলার সন্তানকে নিজের সন্তান হিসাবে লালন পালন করার অনুমতি দেয়া হতো। বাবরের প্রথম স্ত্রী মাহাম বেগম হুমায়ুনের জন্মের পর চারটি সন্তান হারান। তখন তাকে দিলদার বেগমের সন্তান হিন্দাল ও গুলবদনকে লালন পালন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি তাদের বড় করে তোলেন। আকবরের প্রথম নিঃসন্তান স্ত্রী রুকাইয়া সুলতান বেগমের কাছে জন্মের পর শাহজাদা সেলিমের পুত্র খুররমের লালন পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তিনি তাকে লালন পালন করেন। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে লিখেছেন, আমার পিতা খুররমকে লালন পালনের দায়িত্ব তার হাতে ন্যস্ত করেন। তিনি তাকে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসতেন যেন সে ছিল তার নিজের সন্তান। জাহাঙ্গীরের ইচ্ছানুযায়ী শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহজাদা শূজাকে লালন পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নূরজাহান বেগমকে।

 মায়েদের মর্যাদা

মোগল আমলে হেরেমের ফার্স্ট লেডি ছিলেন সম্রাটের মা, তার পাটরানী নয়। তবে নূরজাহান ও মমতাজ মহলের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। রানী মাতার মৃত্যুর পর সম্রাটের পাটরানী তার অবস্থান গ্রহণ করতেন। বাবর থেকে শুরু করে সকল মোগল সম্রাট তাদের মায়েদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। সম্রাটগণ তাদের মায়েদের সীমাহীন ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। বাবরনামা ও হুমায়ুননামায় এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়। অভিষেকের পর সম্রাট প্রথম তার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। উৎসব ও জন্মদিনেও অনুরূপ রেওয়াজ ছিল। কোনো সময় বিরাট ভোজের আয়োজন করা হলে মায়ের প্রাসাদ থেকে আকবরের জন্য মাংসসহ খাবার পাঠানো হতো। একবার আকবরের মা হামিদা বানু পাল্কি দিয়ে লাহোর থেকে আগ্রায় আসছিলেন। এসময় আকবর তার সঙ্গে ছিলেন। এক জায়গায় সম্রাট আকবর তার কাঁধে পাল্কি তুলে নেন এবং একটি নদী পাড়ি দেন। কুতুবউদ্দিন কোকার মা ছিলেন জাহাঙ্গীরের পালিতা মা। তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে তিনি তার মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে লিখেছেন, একইদিন মহামান্য মহারানী মরিয়মুজ্জামানি আগ্রা থেকে এলেন এবং তার জন্য অপেক্ষায় থেকে আমি অনন্ত সৌভাগ্য অর্জন করি। আমি আশা করি তার স্নেহের ছায়া এ দীন প্রার্থীর মাথার ওপর চিরস্থায়ী হবে।

জাহাঙ্গীর তার পালিতা মায়ের মৃত্যুতে লিখেছেন, জিলকদ মাসে কুতুবউদ্দিন কোকার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন আমার মা। তিনি ছিলেন আমার নিজ মায়ের চেয়ে বেশি দয়ালু। আমি তার লাশ কাঁধে তুলে নিই এবং কিছুদূর বহন করে নিয়ে যাই। তার মৃত্যু শোকে আমি কয়েকদিন পর্যন্ত খাবার মুখে তুলতে পারিনি এবং পোশাক পরিবর্তন করিনি।

পালিতা মা ও ধাত্রী

মোগল প্রাসাদে প্রকৃত মা ছাড়া কয়েকজন পালিতা মা ছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা যুদ্ধের মতো ঘটনায় শিশুরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। এসময় হেরেমের অন্য মহিলারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুদের লালন পালন করতেন। এমনকি তাদের স্তন্য পান করাতেন। অন্যান্য ধাত্রীও ছিল। তবে তারা দুধমাতা ছিলেন না। সকল ধাত্রী হেরেমে অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতেন। ধাত্রীরা আনাগা নামে পরিচিত ছিল। শৈশবে আকবর বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় কয়েক বছর তার মা হামিদা বানুর কাছ থেকে দূরে ছিলেন। এসময় আকবরের ধাত্রী হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন শামসুদ্দিনের স্ত্রী জিজি আনাগা, নাদিম খোকার স্ত্রী ফকিরুন্নিসা, তাগ বেগের স্ত্রী কোকি আনাগা, সাদাত ইয়ার কোকার মা পিজি জান আনাগা, খিলদার আনাগা, বিবি রূপা, হুমায়ুনের উপপত্নী ভাওয়াল আনাগা, হাকিমী নামে একজন মহিলা এবং জৈল খান কোকার মা। তবে মাহাম আনাগা ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আকবরের রাজত্বের শুরুতে তিনি বিরাট রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। মোগল সম্রাটগণ তাদের পালিতা মায়েদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। আকবর মাহাম আনাগা ও জিজি আনাগাকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন।

প্রবীণ মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধা

মোগলরা নিজেদের গর্ভধারিণী আপন মা এবং পালিতা মা ছাড়াও সৎ মায়েদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। হীরা কুনওয়ারি ছিলেন জাহাঙ্গীরের আপন মা। কিন্তু তিনি সৎ মা রুকাইয়া বেগমকে বেশি সম্মান করতেন। সেলিমা সুলতান বেগমের প্রতিও ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। আকবর তার সৎ মা হাজী বেগমকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। দাদী, চাচী ও অন্যান্য প্রবীণ আত্মীয় স্বজনকে অত্যন্ত সম্মান ও আদর যত্ন করা হতো। ঐতিহাসিক এ. এস বেভারেজ লিখেছেন, এটা বলা প্রয়োজন, বাবর ও হায়দার উভয়ে এই অভিমত দিয়েছেন যে, প্রবীণ মহিলাদের শ্রদ্ধা করা ছিল তাদের শাসন ও যুগের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এসব প্রবীণ মহিলা রাজনৈতিক সংকটে সম্রাটদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাদের সহযোগিতায় বহু সংকটের নিষ্পত্তি হয়। বাবরনামায় এমন কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয় যেখানে বাবর তার প্রতিপক্ষ শিবিরের মহিলাদের পরম শ্রদ্ধা করতেন। গুলবদন বেগম লিখেছেন, আমার পিতা চার বছর আগ্রায় অবস্থান করেন। এসময় তিনি প্রতি শুক্রবার তার চাচীকে দেখতে যেতেন। একদিন আবহাওয়া ছিল চরম উষ্ণ। আমার মা তাকে বললেন, বাতাস অত্যন্ত গরম। এক শুক্রবার না গেলে কি হয় না? তিনি বললেন, মাহাম, তুমি এমন কথা বলতে পারলে? আবু সাঈদ মির্জার কন্যাদের পিতা ও ভাই নেই। আমি যদি তাদের একটু খোঁজ খবর না নিই তাহলে তাদের দেখবে কে?

 মোগল সম্রাটগণ তাদের বোনদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। গুলবদন বেগম হুমায়ুননামায় এমন বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। বাবর ও হুমায়ুন তাদের বোনদের ভীষণ ভালোবাসতেন। বাবর তার জ্যেষ্ঠা ভগ্নি খানজাদা বেগমকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। খানজাদা বেগমও তার ভাইদের জন্য হাসিমুখে বহু কষ্ট বরণ করেন। গুলবদন হুমায়ুনের আপন বোন ছিলেন না। মায়ের পেটের বোন না হলেও হুমায়ুন তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন এবং তিনি তার অন্য বোনদের খোঁজ খবর নিতেন। কোনো বোন বিধবা হওয়ার মতো বিপদে পড়লে ভাইয়েরা ছুটে যেতেন। বোনকে আশ্রয় দিতেন। গুল চেহারা বেগম বিধবা হলে হুমায়ুন তাকে আগ্রায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে বোন শাকুরুন্নিসা বেগম ও আরাম বানু বেগমের কথা উল্লেখ করেছেন যদিও তাদের জন্ম হয়েছিল আরেক মায়ের গর্ভে।

কন্যা শিশুদের অবস্থান

মোগল পরিবারের কন্যা অথবা মোগল শাহজাদীরা হেরেমে বিরাট সম্মানজনক স্থান দখল করে রাখতো। সে সময় কন্যা শিশুদের জন্ম ছেলে শিশুদের মতো শুভ হিসাবে গণ্য করা হতো না। তবে মোগল সম্রাটগণ তাদের কন্যাদের গভীর ভালোবাসতেন। তাদের শিক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা করতেন। তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিতেন। অফুরন্ত ভোগ বিলাসিতায় মোগল হেরেমে কন্যারা বড় হতো। জীবনে যা যা প্রয়োজন তাই পেতো। তবে আকবরের আমল থেকে তাদের অনেকেই কুমারী ছিল। বহু লেখক ও মানুচির মতো পর্যটকগণ কুমারী থাকার ঐতিহ্য চালু করার জন্য আকবরকে দোষারোপ করেছেন। আকবর তার বোন ও কন্যাদের যোগ্য পাত্রের কাছে বিয়ে দেয়ায় অনেকেই এ অভিযোগের সঙ্গে একমত নন। তবে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে বিয়ে অনুমোদন করেননি। শাহজাহানের সময় থেকে শাহজাদীদের বিয়ের ওপর কতিপয় বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। সম্ভবত সিংহাসনের দাবিদারদের সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য এসব বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তবে আওরঙ্গজেব তার কয়েকজন কন্যা ও ভাতিজিকে চাচাতো ভাইদের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। এই একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া মোগল শাহজাদীরা তাদের পিতা ও ভাইদের কাছ থেকে সবকিছু পেতো। জ্যেষ্ঠা কন্যা জাহানারার প্রতি শাহজাহানের ভালোবাসার কথা সুবিদিত। একইভাবে হুমকি না হওয়া নাগাদ আওরঙ্গজেব তার জ্যেষ্ঠা কন্যা জেবুন্নিসাকে ভালোবাসতেন।

সম্রাটের সহধর্মিনীগণ

সম্রাটের সহধর্মিনীগণ হেরেমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকতেন। তাদেরকে বলা হতো বেগম। মোগল সম্রাটদের প্রত্যেকের বহু স্ত্রী ছিল। তবে স্ত্রীরা সমান মর্যাদা ভোগ করতেন না। সাধারণত পাটরানী ও প্রধান রানীগণ বিশাল অভিজাত মহলে বাস করতেন। তাদের বহু দাসী বাদী ছিল। এসব দাসী বাদী তাদের সেবা করতো। দাসীরা সম্রাটের কাছ থেকে বার্ষিক ভাতা হিসাবে প্রচুর সম্পদ ও অর্থ পেতো। হেরেমে স্ত্রীদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সম্রাটের একটি বিশেষ কক্ষ ছিল। ২০ হাত দৈর্ঘ্য এবং ৮ হাত প্রস্থ এ কক্ষ ছিল আয়না সজ্জিত। কক্ষে ব্যবহৃত স্বর্ণের মূল্য ছিল এক কোটি ৫০ লাখ রুপি। মোগল পরিবারে সাধারণত পিতামাতা অথবা আত্মীয় স্বজন ছেলে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। তবে প্রেমঘটিত বিয়েও হতো। শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে মেহেরুন্নিসার বিয়ে হয়েছিল প্রেমের সূত্র ধরে। সম্রাট আকবর পুত্রবধূ মেহেরুন্নিসার নাম দেন নূরজাহান বা জগতের আলো। শাহজাদা সেলিম আনারকলি নামে এক অপরূপ সুন্দরী নর্তকীর প্রেমে পড়েছিলেন। এ প্রেমের পরিণতি হয়েছিল নির্মম। আকবরের নির্দেশে আনারকলিকে লাহোরে একটি গর্তে জীবন্ত কবর দেয়া হয়।

দ্বিতীয় স্ত্রী

কূটনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসাবে কিংবা যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতীক হিসাবে ভারতীয় রাজাদের কন্যা অথবা আত্মীয় স্বজনদের মোগল শাহজাদাদের কাছে বিয়ে দেয়া হতো। তাদেরকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গণ্য করা হতো। দ্বিতীয় স্ত্রীদের অবস্থান ছিল নিচু। আকবরের আমল থেকে মোগল সম্রাটগণ হিন্দু রাজকুমারীদের বিয়ে করতেন। এসব দ্বিতীয় স্ত্রী বাঈ অথবা মহল হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রধান স্ত্রীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা ছিল নিচে। তা সত্ত্বেও কয়েকজন রাজপুত রাজকুমারী মোগল রাজপরিবারে বিরাট সম্মান ও উঁচু মর্যাদার আসন লাভ করেছিলেন। রাজপুত রাজকুমারী হীরা কুনওয়ারি (যোধা বাঈ) ছিলেন আকবরের প্রথম পুত্র সেলিমের মা। মানবাঈয়ের পুত্র ছিলেন খসরু এবং মানমতি ছিলেন শাহজাহানের মা।

উপপত্মী

বৈধ স্ত্রী ছাড়াও মোগল সম্রাট ও শাহজাদাদের বহু উপপত্মী বা রক্ষিতা ছিল। এসব উপপত্মী সত্যিকারভাবে বৈধ বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন না। তবে তারা স্ত্রীর মতো মহলে বসবাস করতেন। উপপত্মীদের গর্ভজাত সন্তানরা বৈধ স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সমান মর্যাদা পেতো। উপপত্মীদের বলা হতো কানিজ, সাররাক ও পারিস্তার। এছাড়া উপপত্মীরা নাজুক বদন, বদম চসম, সুখ দায়ী, কুতুহান, সিঙ্গার, পিয়ার, মাহান প্রভৃতি নামেও পরিচিত ছিল। সম্রাট আকবর এমন একটি নিয়ম চালু করেন যে, উপপত্মীদের জন্ম যে অঞ্চলে তাদের নামের সঙ্গে সেই অঞ্চলের নাম যোগ করতে হবে। আকবরাবাদি, ফতেহপুরি, আওরঙ্গাবাদি, জৈনাবাদি ও উদয়পুরি নামগুলো হয়েছিল এভাবে। নিচু মর্যাদার অধিকারী হলেও উপপত্মীদের সবসময় নিকৃষ্টতর কিংবা অমর্যাদাকর মনে করা হতো না। কখনো কখনো তারা বৈধ স্ত্রীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতেন।

বাবরের সময় থেকে মোগল হেরেমে সম্রাটদের বহু উপপত্মী ছিল। গুলনাহার আগাচা ও নারগুল আগাচা ছিলেন বাবরের উপপত্মী। তারা ছিলেন ককেশীয় অঞ্চলের দাসী। পারস্য সম্রাট শাহ তাহমাস্প বাবরকে তাদের উপহার দিয়েছিলেন। গুলনাহার আগাচা ও নারগুল আগাচা রাজপ্রাসাদের স্বীকৃত স্ত্রী হিসাবে গণ্য হন। গুলনাহার আগাচা গুলবদন বেগমের সঙ্গী হিসাবে হজ করতে মক্কায় যান। হুমায়ুনের উপপত্মী ভাওয়াল আনাগা ছিলেন আকবরের দুধমাতা। আকবরের বহু উপপত্মী ছিল। কয়েকজন উপপত্মী তার সন্তানের মা হয়েছিলেন। তার কন্যা শাহজাদা খানমের জন্ম হয়েছিল বিবি গালিমার গর্ভে। শাকুরুন্নিসা বেগম ও আরাম বানু বেগমের মা ছিলেন বিবি দৌলত শাদ। আকবরের তিন পুত্রের মধ্যে দু’পুত্র মুরাদ ও দানিয়েলের মা ছিলেন একজন উপপত্নী। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র জাহান্দার ও শাহরিয়ার ছিলেন উপপত্নীর সন্তান। আকবরাবাদি মহল ও ফতেহপুরি মহল ছিলেন শাহজাহানের দু’জন বিখ্যাত উপপত্নী। ঐতিহাসিক ওয়ারিস শাহজাহানের দু’জন ক্রীতদাসীর কথা উল্লেখ করেছেন। এ দু’জন ক্রীতদাসী বন্দিদশায় শাহজাহান ও তার ছেলেমেয়েদের সেবা করতো। সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত দীনদার মুসলমান ছিলেন। তা সত্ত্বেও উদয়পুরি মহলকে তার উপপত্নী হিসাবে কোনো কোনো সূত্র উল্লেখ করছে। ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের মতে, জর্জীয় বংশোদ্ভূত উদয়পুরী মহল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ওপর আমৃত্যু অপ্রতিহত প্রভাব বজায় রেখেছিলেন। সম্রাটের বার্ধক্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রেমময়ী নারী। দাক্ষিণাত্যের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে আওরঙ্গজেব জৈনাবাদী নামে পরিচিত এক ক্রীতদাসীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। জৈনাবাদীর ডাক নাম ছিল হীরা বাঈ। তার সুমিষ্ট কণ্ঠ ও অদ্বিতীয় রূপ আওরঙ্গজেবকে পাগল করে তুলেছিল। ১৬৫২ সালে আওরঙ্গজেব তাকে বিয়ে করেন। অকাল মৃত্যু হওয়ায় তিনি তার জীবনে বেশিদিন অবস্থান করতে পারেননি। এসব উপপত্নী তাদের প্রভুর প্রতি বরাবর বিশ্বস্ত ছিল না। উদয়পুুরি মহল ছিলেন মূলত শাহজাদা দারা শিকোর উপপত্নী। পরে তিনি আওরঙ্গজেবের উপপত্নী হন। উপপত্নীরা কখনো কখনো তাদের প্রভুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতো। তবে সবসময় নয়। অধিকাংশ সময় তারা বিশ্বস্ত থাকতো। রানা-ই-দিল ছিল শাহজাদা দারার উপপত্নী। দারার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর তিনি আওরঙ্গজেবের কাছে ভিড়তে অস্বীকৃতি জানান।

মোগল হেরেমে প্রশাসন, মহিলা প্রহরী, মহিলা চাকরানী ও ক্রীতদাসী হিসাবে বহু মহিলা কাজ করতো। হেরেমে নর্তকী ও গায়িকা ছিল। তারা হেরেমবাসীদের মনোরঞ্জন করতো। নর্তকী ও গায়িকারা কাঞ্চনী হিসাবে পরিচিত ছিল। তারা নাচ গান ছাড়া আর কিছু করতো না। মোগল হেরেমের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত মহিলার নিজস্ব নর্তকী ও গায়িকা ছিল। বাবর তার গুরুত্বপূর্ণ বেগমদের প্রত্যেককে একজন করে নর্তকী উপহার দিয়েছিলেন। এসব নর্তকী হেরেমে বসবাস করতো। হেরেমের মহিলাদের চিত্তবিনোদনে বাইরে থেকেও নর্তকী আসতো। 

 শিক্ষা

মোগল হেরেমের মহিলারা ছিলেন খুবই শিক্ষিতা। তারা পড়াশোনা ও কবিতা লিখায় ব্যস্ত থাকতেন। মোগল সম্রাটগণ মহিলাদের শিক্ষাদানে কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রবীণ মহিলাকে নিয়োগ করেছিলেন। শিক্ষাদানে নিযুক্ত মহিলা শিক্ষিকাদের বলা হতো আতুন মামা। আকবরের সময় হেরেমের মহিলাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তিনি তার প্রাসাদে মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল হিসাবে কয়েকটি কক্ষ বরাদ্দ করেন। মোগল সম্রাটগণ তাদের কন্যাদের শিক্ষাদানে সাধারণত শিক্ষিত পার্সী মহিলাদের নিয়োগ করতেন। শাহজাহান তার কন্যা জাহানারাকে সাহিত্যে পাঠদানে সাতিউন নিসা বেগমকে নিযুক্তি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব হাফিজা মরিয়ম ও আশরাফ মাজিনদারানীকে তার মেয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মাজিনদারানী ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও তার সময়ে সুপরিচিত একজন ফারসি কবি। হেরেমের মহিলাদের পাঠ্যসূচিতে থাকতো আরবী, ফারসি, ধর্ম ও ইতিহাস। কোনো কোনো মহিলা কোরআন হেফজ করেছিলেন।

সঙ্গীত

সঙ্গীত ছিল হেরেমের মহিলাদের অত্যন্ত প্রিয়। পুরান মহলের স্ত্রী রত্মাবলী তার সুরেলা কণ্ঠে হিন্দি গান গাইতেন। রাজা মানসিংহের স্ত্রী মারিগনাইনি ছিলেন সঙ্গীতে পারদর্শী। মীরা বাঈ ছিলেন তখনকার দিনের একজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। আকবরের রাজসভার সঙ্গীত বিশারদ নায়েক বকশির কন্যা ছিলেন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। কিংবদন্তীতুল্য সঙ্গীতজ্ঞ মিয়া তানসেন বকশির কন্যার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণে কিছুদিন দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেছিলেন। বহু মোগল পেইন্টিংয়ে নর্তকী ও গায়িকাদের পারফরমেন্স চিত্রিত করা হয়। পেইন্টিংয়ে ঢাক, তাম্বুরা, দফ ও সেতারের মতো বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে সঙ্গীত পরিবেশনরত মোগল মহিলাদের ছবি অঙ্কন করা হয়। একসঙ্গে তের জোড়া তারে সুর তুলে মহিলা শিল্পীরা গান গাইতেন। এসব গায়িকা ছিলেন মূলত গুজরাট ও মালবের। রাজস্থানে মোগল হেরেমের তের তাল এখনো বেশ জনপ্রিয়। দাদি মহিলারা দাহাদা নামে একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। তারা দফ, দাফজান ও তাম্বুরাও বাজাতে পারতেন। কাঞ্চরি নামে মহিলা ও পুরুষ গায়কদের একটি দল ছিল। আকবর এ গ্রুপের নাম পাল্টে নামকরণ করেন কাঞ্চন। শাহজাহান ব্যস্ত সময়েও গান শোনতেন। তিনি রাতের আসরে উপপত্মীদের নাচ গানে নিয়োজিত করতেন। হীরা বাঈ ছিলেন শাহজাহানের আমলের একজন বিখ্যাত গায়িকা। আওরঙ্গজেবের আমলের শুরুতে সরোজ বাঈ ছিলেন আরেকজন জনপ্রিয় গায়িকা। তিনি ছিলেন শাহজাদা মুরাদ বকশের প্রিয়পাত্রী। আওরঙ্গজেব মুরাদ বকশকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করেন। তার সঙ্গে সরোজ বাঈও বন্দি ছিলেন। বন্দিশালায় তিনি অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হন। আওরঙ্গজেবের আমলে নূর বাঈ ছিলেন আরেকজন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। নূর বাঈ তার দরাজ কণ্ঠে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত গাইতেন।

পোশাক

মোগল মহিলারা ভারতে এসে পৌঁছানোর সময় লম্বা গাউন, তুর্কি টুপি ও ট্রাউজার পরতেন। গাউনের নিচে থাকতো খাটো বডিস হিসাবে কাতিজী। আকবরের আমলের আগ পর্যন্ত মোগল মহিলারা পার্সী পোশাক পরতেন। তবে তার সময় রাজপুত পোশাক গ্রহণ করা হয়। পোশাকের বিভিন্ন ডিজাইনে হেরেমের মহিলারা তাদের রূপ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে যৌনাবেদনময়ী কৌশল গ্রহণ করতেন। সম্ভ্রান্ত মহিলারা আভিজাত্যপূর্ণ ও দামি পোশাক পরতেন। কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক তাদের পোশাকের বর্ণনা দিয়েছেন। ফঁ্রাসোয়া বার্নিয়ার বলেছেন, মোগল মহিলাদের পোশাকের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারা এক পোশাক দু’বার পরতেন না। ব্যবহৃত পোশাক বাদীদের পরতে দেয়া হতো। এসব পোশাকের দাম ছিল সাধারণত ১০ থেকে ১২ রুপি। তবে জমকালো পোশাকের দাম ছিল আরো বেশি। মানুচির মতে, হেরেমের মহিলাদের প্রতিটি পোশাকের দাম ছিল অন্তত ৪০ থেকে ৫০ রুপি কিংবা তার চেয়ে অধিক। পোশাকে ব্যবহার করা হতো সিল্ক, ডোরিয়া, জারবাফট (সোনালী সূতার কারুকাজ করা পোশাক) তিলাদোজ, মুক্কেশকর, কামখাওয়াব (সোনালী পোশাক), কালাবাত্ত, মসলিন বিশেষ করে মালবের মসলিন। মোগল হেরেম, অভিজাত ও অমাত্যদের জন্য কেবলমাত্র মসলিন কাপড় পাঠানোর জন্য বণিকদের নির্দেশ দেয়া হতো। বাবর ও হুমায়ুনের আমলে মহিলাদের পোশাকে খোরাসান ও মধ্য এশিয়ার ফ্যাশন অনুসরণ করা হতো। হেরেমের মহিলারা প্রশস্ত, ঢিলা ও রঙ্গীন অন্তর্বাস পরতেন। নিমতেনা হিসাবে পরিচিত আরেকটি জ্যাকেট ব্যবহার করা হতো। হিন্দু মহিলারা লাল পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। তাদের পরিধেয় পোশাকের নাম ছিল চোলি। চোলির নিচে হিন্দু মহিলারা পরতেন শাড়ি।

হুমায়ুনের সময় কুমারী মেয়েরা তাকি নামে ঝুটিদার একটি টুপি পরতো। বিবাহিত মহিলারা তাকির সঙ্গে কাসাবা নামে পরিচিত একটি মস্ককাবরণ পরতেন। মহিলাদের মূল পোশাকের নাম ছিল আঙ্গা। আঙ্গা ছিল পুরো বা অর্ধেক আস্তিনের বডিস বা জ্যাকেট। মহিলারা তাদের শরীরের নিচের অংশ ঢেকে রাখতেন হয়তো আঁটসাট ট্রাউজার কিংবা লাঙ্গা দিয়ে। দোপাট্টার মূল্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন। মহিলাদের মস্ককাবরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হতো খুব বেশি। কোনো কোনো মহিলা ঘোমটা বা মিজারের আড়ালে তাদের মুখ ঢেকে রাখতেন। অভিজাত মহিলারা কাশ্মীরে তৈরি পশমের কাবাস পরতেন। কাশ্মীরী পশম এত সূক্ষ্ণ ছিল যে, একটি ক্ষুদ্র আংটির মধ্য দিয়ে অনায়াসে একটি কাবাস ঢুকানো যেতো।

মিনাবাজার

মোগল মহিলারা যাতে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে হাঁপিয়ে না উঠেন সেজন্য মিনাবাজারের আয়োজন করা হতো। নওরোজ বা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত আট দিনব্যাপী মিনাবাজারে সর্বস্তরের মহিলারা কেনা কাটার জন্য ভিড় করতেন। সম্রাট শাহজাহান তার আমলে একটি মিনাবাজারে ত্রিশ হাজার মহিলাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শাহজাদা হিসাবে এমন একটি মিনাবাজারে তিনি আর্জুমান্দ বানু বেগমকে দেখতে পেয়েছিলেন। প্রথম দর্শনে তিনি তার রূপে মুগ্ধ হন। তাকে বিয়ে করেন এবং মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নির্মাণ করেন তাজমহল। তাই বিদেশি ইউরোপীয় পর্যটকরা মিনাবাজারকে কদর্যভাবে দেখেছেন। তারা মনে করতেন, শাহজাদাদের পছন্দ মতো মেয়ে খুঁজে বের করার জন্য মিনাবাজারের আয়োজন করা হতো। তাদের ধারণা সঠিক নয়। মোগল সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীগণও মিনাবাজারে যেতেন। মিনাবাজার ছিল মেয়েদের একটি মিলনমেলা। মোগল সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীগণ মিনাবাজারে ঘুরে ঘুরে দামদর করতেন। মহিলা ক্রেতাদের সঙ্গে রসিকতা করতেন। বেশি দাম দিয়ে পণ্য ক্রয় করতেন। এই একটি মাত্র অনুষ্ঠানে রাজা ও প্রজা একাকার হয়ে যেতো।

ক্রীতদাসী ও দাসী

হেরেমে ক্রীতদাসী ও দাসীরা নিচু স্তরে অবস্থান করলেও প্রধান মহিলা দাসী কিংবা হেরেমের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সঙ্গিনী হিসাবে উন্নততর মর্যাদা ভোগ করতো এবং তাদের হাতে কখনো কখনো ব্যাপক ক্ষমতা থাকতো। সম্রাট, রানী অথবা সম্রাটের ছেলেমেয়েদের বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে তাদের নিয়োজিত করা হতো। তারা তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতো। মোগল সম্রাটদের স্মৃতিকথা এবং গুলবদন বেগমের হুমায়ুননামা এবং ঐ সময়ের আরো কিছু বর্ণনায় আনুগত্য ও সেবার জন্য সুপরিচিত কয়েকজন দাসীর কথা উল্লেখ করা হয়। জনৈক আতুন মামা বাবরের মা কুতলুগ নিগার খানমের সেবায় নিয়োজিত ছিল। বাচাকা খলিফা ছিল বাবরের প্রাসাদের প্রধান মহিলা দাসী। জাহাঙ্গীর তার স্মৃতিকথায় আকা আকায়াম নামে এমন একজন প্রধান দাসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মমতাজ মহলের অনুগত সঙ্গিনী ছিল সাতিউন নিসা। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা এবং শাহজাদী জাহানারাকে শিক্ষা দিতেন। তিনি মমতাজ মহল ও জাহানারাকে তাদের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করতেন। সম্রাট, সম্রাজ্ঞী ও শাহজাদীরা তাকে অসম্ভব বিশ্বাস করতেন। দাসীদের বলা হতো বান্দী। নপুংসক পুরুষ দাসদের বলা হতো খোজা অথবা পারিস্তার। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ব্যক্তিগত খেদমতে কখনো কখনো ১০/১২ জন দাসীর প্রয়োজন হতো। দাসীদের কোনো স্বাধীনতা বা অধিকার ছিল না। হেরেমের গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের সেবা করার সুযোগ লাভের ওপর তাদের ভাগ্য নির্ভর করতো। মানুচি কয়েকজন দাসীর কথা উল্লেখ করেছেন। তারা হলো গোলাপ, চম্পা, চামেলি, নার্গিস, কেসার, কস্তুরি, গুল-ই-বদন, গুল-ই-রানা, গুল আন্দাম, গুল আনার, গুলরাং, মেহেদী, সোসান, সালোনি, ইয়াসমিন, মধুমতী, সুগন্ধরা, দিল আফরোজ, মোতি, কেতকী, সোহবতী, আচানক, রংমালা, কিশমিশ, পেস্তা, কোয়েল, বাসন্তী প্রমুখ। হিন্দু ক্রীতদাসীদের এসব নাম দেয়া হয়েছিল। শৈশবে বিভিন্ন গ্রাম অথবা বিদ্রোহী হিন্দু রাজাদের গ্রাম থেকে এসব ক্রীতদাসীকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। হিন্দু নাম সত্ত্বেও ক্রীতদাসীরা ছিল মুসলমান। প্রভুর অনুমতি নিয়ে গোলাম ও ক্রীতদাসীরা বিয়ে করতে পারতো। ক্রীতদাসীদের নাগমা ও গজল শিখানো হতো। মানুচি মোগল রাজদরবারে প্রাসাদের দরজায় সার্বক্ষণিক কাশ্মীরী মহিলাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পান। প্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে নেয়া এবং হাজির করা ছিল তাদের কাজ। তাদের মাথায় ঘোমটা ছিল না। উর্ধ্বতন মহিলা কর্মকর্তারা দাসীদের ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করতেন। 

 রাজকীয় মহিলাদের প্রদত্ত খেতাব

কয়েকজন মোগল রমনীকে তাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে খেতাব দেয়া হয়েছিল। ইতালীয় পরিব্রাজক ম্যানুয়েল মানুচি লিখেছেন, সম্রাট মহিলাদের সঙ্গে মানানসই খেতাব দেয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন। মোগল সম্রাটদের মায়েরা ছিলেন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের অধিকাংশকে খেতাব দেয়া হয়েছিল। আকবরের মা হামিদা বানু বেগমের খেতাব ছিল মরিয়ম মাকানি। মরিয়ম মাকানি শব্দটির অর্থ হলো উভয় জগতের মরিয়ম। জাহাঙ্গীরের মা হীরা কুনওয়ারিকে দেয়া হয়েছিল মরিয়মুজ্জামানি খেতাব। এ খেতাবটির মানে হলো সারা বিশ্বের মরিয়ম। শাহজাহানের মা মানমতিকে দেয়া হয়েছিল বিলকিস মাকানি খেতাব। তার অর্থ হলো পবিত্র নিবাসের মহিলা। মোগল সম্রাটদের মায়েদের আভিজাত্যপূর্ণ খেতাব দেয়ার পাশাপাশি তাদের প্রিয়তমা রানী, প্রিয়তম বোন ও কন্যাদেরও অনুরূপ খেতাব দেয়া হতো। খসরুর জন্ম হওয়ার পর জাহাঙ্গীর তার প্রথম স্ত্রী মান বাঈকে শাহ বেগম খেতাব দিয়েছিলেন। ১৬১১ সালে জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করে তাকে নূরমহল খেতাব দেন। নূরমহল খেতাবের অর্থ হলো প্রাসাদের আলো। ১৬১৬ সালে সিংহাসনে আরোহণের একাদশ বর্ষের ভোজসভায় জাহাঙ্গীর তার খেতাব পরিবর্তন করে নূরজাহান খেতাব দেন। নূরজাহান খেতাবের মানে হলো পৃথিবীর আলো। পরবর্তীতে নূরজাহান বেগম পাদশাহ বেগম উপাধি গ্রহণ করেন। শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী আর্জুমান্দ বানু বেগমকে মমতাজ মহল খেতাব দেয়া হয়। ফরাসি পরিব্রাজক ফঁ্রাসোয়া বার্নিয়ার মমতাজ মহলকে তাজি মিহালি (Tage Mehalle)হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মমতাজ মহল মালিকা-ই-জাহান খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন। এ খেতাবের মানে হলো বিশ্বের আলো। তিনি নবাব মাহদ উলা খেতাবও পেয়েছিলেন। নবাব মাহদ উলা খেতাবের অর্থ হলো মহারানী। শাহজাহনের প্রিয়তম কন্যা জাহানারা বেগম সবার কাছে বেগম সাহিব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। নবাব উলা খেতাবও তিনি ব্যবহার করতেন। পরে তাকে পাদশাহ বেগম খেতাব দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাকে দেয়া হয়েছিল সাহিবাত-উজ-জামানি খেতাব। যার অর্থ যুগের শাহজাদী। আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় কন্যা জিন্নাতুন্নিসা বেগমের খেতাব ছিল পাদশাহ বেগম।

হেরেমের মহিলাদের আবাসিক মহল

আজ পর্যন্ত বিদ্যমান প্রাসাদ ও দুর্গগুলো মোগলদের আভিজাত্য ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপনের প্রমাণ বহন করছে। হেরেমের মহিলারা অদ্বিতীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশাল বিশাল মহলে বসবাস করতেন। এসব মহিলার আবাসিক ভবনগুলোকে বলা হতো মহল বা সাহিবিস্তান-ই-ইকবাল অথবা সাহিবিস্তান-ই-খাস। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের আবাসিক মহলগুলো ছিল প্রাসাদের অংশ। একইভাবে প্রাসাদ ছিল দুর্গের অংশ। শাহী মোগল মহিলাদের অনুপম আবাসিক মহলগুলো দিল্লি, আগ্রা, ফতেহপুর সিক্রি ও লাহোর দুর্গে এখনো দেখা যায়। ফতেহপুর সিক্রিতে বীরবলের কন্যার মহলের মতো মহিলাদের পৃথক মহল ছিল। জাহাঙ্গীরের মায়ের মহলের নাম ছিল মরিয়ম মহল। এ মহল সোনাহলা মহল বা সোনালী ভবন নামেও পরিচিত ছিল। আকবরের প্রথম স্ত্রী রুকাইয়া সুলতানা বেগমের মহলের নাম ছিল রুমী বা তুর্কি সুলতানার প্রাসাদ। এমনকি দুর্গের অভ্যন্তরে প্রাসাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়েও মহল নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব মহলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দিল্লির লালকেল্লার অভ্যন্তরে রংমহল অথবা ইমতিয়াজ মহল, মতি মহল, হীরা মহল। হেরেমের মহিলাদের জন্য এসব মহল নির্মাণ করা হয়েছিল। লালকেল্লার একটি ক্ষুদ্র অংশে ছিল এসব মহল। হেরেমের সব বাসিন্দাকে পৃথক ও বিশাল কোয়ার্টার প্রদান করা হতো না। তবে আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন, সম্রাট আকবর হেরেমের ৫ হাজার মহিলাকে পৃথক কোয়ার্টার দিয়েছিলেন। আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে এত আবাসিক কোয়ার্টার ছিল না যেখানে ৫ হাজার মহিলা বসবাস করতে পারতেন। তবে একথা নিশ্চিত যে, বিশেষ বিশেষ শাহী মহিলার জন্য পৃথক পৃথক আবাসিক কোয়ার্টার ছিল। মহলের সব মহিলা বাসিন্দাকে বসবাসের জায়গা দেয়া হতো। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের চাকরানীদের জন্য আলাদা আবাসিক গৃহ ছিল। কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলার দাসীর সংখ্যা ছিল ১০, ২০ অথবা ১০০। তবে এ ধরনের সুবিধাপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। পৃথক আবাসস্থল পেলেও সম্ভ্রান্ত মহিলারা সেখানে নিঃসঙ্গ বসবাস করতেন না। তাদের কোয়ার্টারে বহু দাসী ও সঙ্গিনী বসবাস করতো। নর্তকী, গায়িকাসহ আরো কত লোক! হেরেমের মহিলাদের এসব আবাসস্থল থাকতো সাধারণত দুর্গের গভীর অভ্যন্তরে। দাসী, বাদী ও নর্তকীরা বসবাস করতো দুর্গের প্রধান ফটকের ভেতর একটি জায়গায়। এই জায়গাকে বলা হতো চক। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলার প্রাসাদ ছিল দুর্গের বাইরে। যমুনার কাছে আগ্রায় যেসব প্রাসাদ দেখা যায় সেগুলো ছিল আকবরের স্ত্রী রুকাইয়া বেগম সুলতান ও শাহজাহানের বোন শাহজাদী বেগমের। আগ্রা, লাহোর ও কাশ্মীরে নূরজাহান ও জাহানারা বেগমের প্রাসাদ ছিল। বহু বিদেশি পর্যটক মোগল শহর ও দুর্গগুলো পরিদর্শন করেছেন। তারা এসব দুর্গে মহিলাদের প্রাসাদের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে নিজের চোখ দিয়ে দেখে নয়। অন্যের কাছ থেকে শুনে। মোগল হেরেমে বহিরাগত ও পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় বিদেশিরা স্থানীয় লোক, খোজা অথবা দাস দাসীদের কাছ থেকে মহিলাদের প্রাসাদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ফরাসি পর্যটক ফঁ্রাসোয়া বার্নিয়ার লিখেছেন, সম্রাট দিল্লিতে অনুপস্থিত থাকলে আমি কখনো কখনো প্রাসাদে প্রবেশ করতাম। একবার একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা গুরুতর অসু্*স্থ হয়ে পড়েন। তাকে বহিঃস্থ দ্বার দিয়ে বের করা সম্ভব না হওয়ায় চিকিৎসার জন্য আমাকে ডাকা হয়। তবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কাশ্মীরী শাল দিয়ে আমাকে আপদমস্তক ঢেকে যেতে হয়। একজন খোজা আমাকে হাত ধরে নিয়ে প্রবেশ করে। যেন আমি একজন অন্ধ। খোজারা আমাকে জানায় যে, মনোমুগ্ধকর ভবন নিয়ে হেরেম গড়ে উঠেছে। প্রতিটি মহিলার আবাসস্থল পৃথক। মহিলাদের মর্যাদা ও আয় অনুযায়ী সেগুলো কম বেশি প্রশস্ত। প্রতিটি আবাসিক ভবনের দরজায় চলন্ত পানির নহর। মহলের চারদিকে বাগান। চমৎকার অলিন্দ, ছায়াঘেরা নিকুঞ্জ, ঝরনা, ফোয়ারা, দিবাভাগে সূর্যের আলো থেকে ছায়া লাভের ব্যবস্থা, নরম তুলতুলে গদি, চন্দ্রাতপ। চন্দ্রাতপে রাতে ঘুমালে শরীর জুড়িয়ে যায়। জমকালো প্রাসাদের দেয়ালের অভ্যন্তরে কোনো তাপ বা ক্লান্তি নেই।

ইউরোপীয় পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ ও ডি লয়েন্ট আগ্রা ও লাহোর দুর্গের অভ্যন্তরে হেরেমে বসবাসকারী মহিলাদের স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। ডি লয়েন্ট আগ্রা দুর্গের অভ্যন্তরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, সুউচ্চ ভূমিতে দণ্ডায়মান এ দুর্গ হচ্ছে একটি বিস্ময়কর জায়গা এবং সবদিক বিশেষ করে নদীর দিক থেকে দেখলে অত্যন্ত চমৎকার। নদীর তীরবর্তী অংশে রয়েছে সোনালী জানালাবিশিষ্ট গ্যালারি। এ গ্যালারি থেকে সম্রাট হাতির লড়াই প্রত্যক্ষ করেন। গ্যালারির পেছনে শ্রোতাদের চেম্বার। এ চেম্বারকে বলা হয় গোসলখানা। গোসলখানার নিচে নূরজাহান বেগমের মতো মহিলাদের মহল। দুর্গের বাদবাকি অংশে আরো বেশ কয়েকটি ভবন। এসব ভবনের মধ্যে মহিলাদের মহল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের মা মরিয়মুজ্জমানি এমন একটি মহলে বাস করেন। আরো তিনটি প্রাসাদে সম্রাটের উপপত্নীরা বাস করেন। একটি প্রাসাদের নাম লিথাবার (রোববার), দ্বিতীয়টির নাম মঙ্গল (মঙ্গলবার) এবং তৃতীয়টির নাম জেনিসার (শনিবার)। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সম্রাট এসব প্রাসাদে খুব একটা আসেন না। মহিলাদের জন্য পঞ্চম একটি প্রাসাদ রয়েছে। এ প্রাসাদে সম্রাটের বিদেশি উপপত্নীরা বসবাস করেন। এ প্রাসাদকে বলা হয় বাঙালি মহল।

মোগল হেরেমের মহলগুলো শুধু বিশাল ছিল তাই নয়, সেগুলো ছিল অত্যন্ত সুসজ্জিত। মহলগুলো ছিল সূক্ষ্ণ মার্বেল পাথরে তৈরি। মার্বেল পাথরগুলো ছিল স্বর্ণ ও মূল্যবান রত্মে খোদাই করা। মহলের মেঝেগুলো ছিল কারুকাজ করা পুরু ও মসৃণ পার্সী কার্পেটে মোড়ানো। মহলের কলামের ভিত্তিগুলো ছিল রৌপ্যের ফাঁপা স্তম্ভমূলে প্রোথিত। আরো ছিল আভিজাত্যপূর্ণ পর্দা, দুর্লভ আসবাবপত্র, সুদৃশ্য আয়না, প্রসাধনী, ফুলদানি ও সোনালী বাতি। দেয়ালগুলোতে ছিল অনুপম কারুকাজ। মহলগুলোর পাশে ছিল মোহনীয় বাগান। বাগানে ছিল বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ, উদ্ভিদ, চারাগাছ, ঝরনা, ক্ষুদ্র জলাশয়, নহর, কৃত্রিম জলপ্রপাত ও পুকুর। পুকুর ও ক্ষুদ্র জলাশয়গুলোকে সাজসজ্জা এবং মহিলাদের গোসলের জন্য ব্যবহার করা হতো। পুকুরগুলো ছিল বেশ বড় ও গভীর। ক্ষুদ্র জলাশয় ও পুকুরে ঝরনাবাহিত কুয়া থেকে বালতি লাগানো বায়ুচালিত বিশাল চাকার সাহায্যে প্রতিদিন পানি সরবরাহ করা হতো।

রাজকীয় মহিলাদের সম্পদ ও ব্যয়ের উৎস

মোগল হেরেমের রাজকীয় মহিলারা অমিতাচারী জীবন যাপন করতেন। গুরুত্বপূর্ণ মহিলারা ছিলেন প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক। তারা তাদের ইচ্ছামতো এসব অর্থ ব্যয় করতেন। পদস্থ মহিলা, রানী ও শাহজাদীরা ভাতা এবং ব্যক্তিগত ব্যয় ও চাহিদা মেটাতে মঞ্জুরী পেতেন। ইউরোপীয় পর্যটক মানুচি বলেছেন, রানী ও শাহজাদীরা তাদের জন্ম অথবা পদমর্যাদা অনুযায়ী বেতন ও পেনশন পেতেন। এছাড়া তারা সম্রাটের কাছ থেকে পান, প্রসাধনী অথবা জুতা ক্রয়ের অজুহাতে লোভনীয় উপঢৌকনও লাভ করতেন। নিয়মিত বেতন ভাতা ছাড়াও রাজকীয় মহিলারা ছিলেন বিশাল বিশাল জায়গীরের মালিক। সিংহাসনে উপবেশন করেই সম্রাট হুমায়ুন তার মা, বোন ও মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের জায়গীর প্রদান করেন। একইসঙ্গে তিনি তাদের মনসব বা মর্যাদা নিশ্চিত করেন। পরবর্তী সম্রাটদের কাছ থেকেও সম্ভ্রান্ত মহিলারা জায়গীর লাভ করেন। ১৬০৫ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসেই মহিলাদের জায়গীর বরাদ্দ দেন। এ ব্যাপারে তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমি অবস্থা ও সম্পর্ক অনুযায়ী আমার পিতার হেরেমের পর্দানসীন মহিলাদের ভাতা ২০ থেকে একশো শতাংশে উন্নীত করেছি।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান সর্বোচ্চ সংখ্যক জায়গীর বরাদ্দ পেয়েছিলেন। আজমীর থেকে ২০ মাইল দক্ষিণ পূর্বদিকে রামসার জায়গীর এবং তোদা পরগনার বার্ষিক রাজস্ব ছিল ২ লাখ রুপি। নূরজাহানের সিকান্দারাবাদে স্থানীয় শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা ছিল। তার নিজস্ব উকিল এসব পরগনা দেখাশোনা করতেন। শাহজাহান তার স্ত্রীদের প্রচুর জায়গীর বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তার সময় সব পদস্থ মহিলার ব্যক্তিগত নাজির ছিল। নাজির হেরেমের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জায়গীর, সম্পত্তি ও আয় তদারক করতেন। শাহজাহান শাহজাদী জাহানারাকে সর্বাধিক জায়গীর প্রদান করেছিলেন। রাজকীয় মহিলারা নগদে বিশেষ উপহার পেতেন। পানিপথে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে জয়লাভের পর সম্রাট বাবর প্রত্যেক বেগমকে একজন করে নতর্কী, মনি মানিক্য বোঝাই একটি সোনার থালা, আশরাফি বোঝাই মুক্তার দু’টি ক্ষুদ্র ট্রে এবং দু’টি থালা ভর্তি শাহরুখি এবং ৫টি থালা বোঝাই উপহার সামগ্রী প্রদানের নির্দেশ জারি করেন। আকবর নওরোজ উৎসবে হেরেমের মহিলাদের মূল্যবান অলঙ্কার উপহার দিতেন। জাহাঙ্গীর এ ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিলেন। শাহজাদা হিসাবে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর শাহজাহান তার সৎ মা নূরজাহানকে ২ লাখ রুপি উপহার দিয়েছিলেন। তার বেগম ও মায়েদের দিয়েছিলেন আরো ৬০ লাখ রুপি। মোগল সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে তিনি তার হেরেমের পদস্থ মহিলাদের মধ্যে ৬০ লাখ রুপি বিলিয়েছিলেন। মমতাজ মহলকে দিয়েছিলেন ২ লাখ আশরাফি ও ৬ লাখ রুপি এবং কন্যা জাহানারা বেগমকে ৪ লাখ রুপি। প্রথম নওরোজ উৎসবে তিনি মমতাজকে দিয়েছিলেন ৫০ লাখ রুপি মূল্যের রত্ম ও গহনা এবং জাহানারাকে ২৫ লাখ রুপির গহনা। অন্য শাহজাদা ও শাহজাদীদের দিয়েছিলেন আরো ২৫ লাখ রুপি। সেদিন এক কোটি ৮০ লাখ রুপির মধ্যে এক কোটি ৬০ লাখ বিলিয়েছিলেন রানী, শাহজাদী ও শাহাজাদাদের মধ্যে। শাহজাহান তার ৪৬ বছর পূর্তি উৎসবে কন্যা জাহানারা বেগমকে উপহার দিয়েছিলেন ২ লাখ রুপি। জাহানারা বেগম আগুনে পুড়ে গিয়েছিলেন। ৮ মাস পর ১০৫৬ হিজরিতে তিনি সু্*স্থ হয়ে উঠলে তাকে দেয়া হয়েছিল ১০ লাখ রুপি মূল্যের গহনা। সম্রাট শাহজাহান তাকে হাতের বালা তৈরি করার জন্য আরো দিয়েছিলেন ১৩০টি মুক্তা। তিনি তাকে মুক্তা ঝুলানো বিরাট হীরা বসানো একটি সারবান্দও দিয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে হেরেমের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের উপহার দিতেন। সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে তিনি বেগমদের প্রচুর উপঢৌকন দিয়েছিলেন। যুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন দেয়ায় তিনি বোন রওশনারা বেগমকে ৫ লাখ রুপি উপহার প্রদান করেন। তার চার কন্যাকে দিয়েছিলেন যথাক্রমে ৪ লাখ, ২ লাখ, এক লাখ ৬০ হাজার ও দেড় লাখ রুপি। শাহজাদা মোহাম্মদ আজমের পুত্র সন্তান জন্ম হলে আওরঙ্গজেব পুত্রবধূ জাহানজেব বানু বেগমকে ৭ লাখ রুপি মূল্যের একটি সামারানসহ ১০ লাখ রুপি মূল্যের মুক্তার হার উপহার দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আজমের কন্যা গীতিআরা বেগমকে দিয়েছিলেন একটি দামি কারা।

বিদেশি বণিক ও রাষ্ট্রদূতরা সম্রাটের অনুগ্রহ লাভে রাজকীয় মহিলাদের উপহার দিতেন। ১৬০৮ সালে ইংরেজ দূত উইলিয়াম হকিন্স জাহাঙ্গীরের বোন শাকুরুন্নিসা বেগমকে কয়েকটি মূল্যবান অলঙ্কার উপহার দিয়েছিলেন। আরেকজন ইংরেজ টমাস কোরয়াত জাহাঙ্গীরকে একটি রুবি উপহার দিয়েছিলেন। পরে জাহাঙ্গীর এ রুবি তার স্ত্রীকে উপহার দেন। ইংরেজ দূত স্যার টমাস রোহ রাজকীয় কৃপা লাভে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে বহু দামি ও দুর্লভ উপহার দিয়েছিলেন। এসব উপহারের মধ্যে ছিল ইংলিশ কোচ, খেলনা ও আয়নার একটি দেরাজ।

মোগল হেরেমে বসবাসকারী রাজকীয় মহিলারা বিপুল ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন। সম্রাটের জীবনে যিনি যত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারতেন তিনি তত ধনশালী হতেন। হেরেমের মহিলারা স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা, মনি মানিক্য, জহরত ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছাড়াও লাখ লাখ রুপি উপার্জন করতেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তাদের প্রিয়তম স্বামী, পিতা অথবা ভাইয়েরা তাদের বার্ষিক ভাতা বৃদ্ধি করতেন। শাহজাহান মমতাজ মহলের জন্য বার্ষিক ১০ লাখ রুপি ভাতা নির্ধারণ করেন। জাহানারা বেগমের ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ লাখ রুপি। মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর এক কোটি রুপি মূল্যের স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীসহ তার গোটা সম্পদের অর্ধেক জাহানারাকে প্রদান করা হয়। জাহানারার ভাতা ৬ থেকে ১০ লাখ রুপিতে উন্নীত করা হয়। মানুচির হিসাব মতে, মূল্যবান হীরা ও রত্ম বাদে জাহানারার বার্ষিক আয় ছিল ৩০ লাখ রুপি। মৃত্যুর সময় তিনি তার ভাতিজিদের মধ্যে তার অলঙ্কার ও সম্পদ ভাগ করে দিয়ে যান। দারা শিকোর কন্যা জানি বেগম পেয়েছিলেন তার উৎকৃষ্ট অলঙ্কার ও অর্থের সিংহভাগ। সম্রাট স্বামীর মৃত্যুর পর পরবর্তী সম্রাটগণ হেরেমের গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের বার্ষিক ভরণ পোষণের ভাতা প্রদান করতেন। শাহজাহান সিংহাসনে আরোহণ করে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের বার্ষিক ভরণ পোষণ ভাতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এ ভাতার পরিমাণ ছিল ২ কোটি রুপি।

 মোগল মহিলারা বিভিন্ন উপায়ে তাদের অর্থ ব্যয় করতেন। দৈনন্দিন ব্যয় ছাড়াও তারা সূক্ষ্ণ সিল্ক ও মসলিন কাপড় এবং ব্রোকেড ক্রয় করতেন। দামি রত্ম ও অলঙ্কারের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক ছিল। অজ্ঞাত উৎস থেকে তারা দুষ্প্রাপ্য রত্ম ক্রয় করতেন। সাজসজ্জার জন্য তারা দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করতেন। নিজ ব্যয়ে কোনো কোনো মহিলা প্রাসাদ, সমাধি, বাগান, মসজিদ, সরাইখানা এমনকি বাজার পর্যন্ত নির্মাণ করতেন। হুমায়ুনের স্ত্রী বেগা বেগম তার স্বামীর মাজারের পাশে একটি কলেজ এবং আকবরের দুধমাতা মাহাম আনাগা দিল্লিতে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একইভাবে জাহানারা বেগম আগ্রায় জামা মসজিদের কাছে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হেরেমের মহিলারা দীন দুঃখীদের অকাতরে দান করতেন। লাভজনক ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ করতেন। মোগল রানী ও শাহজাদীরা অতিথি আপ্যায়ন এবং বিরাট বিরাট ভোজের আয়োজন করতেন। কখনো কখনো ভোজে বিপুল ব্যয় করা হতো। জন্মদিন, বিয়ে, অভিষেক ও বিজয় উপলক্ষে তারা তাদের প্রিয়জনদের দামি উপহার দিতেন। ১৫৩০ সালে হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে তার মা মাহাম বেগম এক রাজকীয় ভোজের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে প্রায় ৭ হাজার লোককে সম্মানসূচক বিশেষ পোশাক উপহার দেয়া হয়। নূরজাহান বেগম রাজকীয় ভোজের আয়োজন করার জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। লোকজনকে তিনি মূল্যবান উপহার দিতেন। শাহজাদা খুররম রাজপুতানা থেকে সফল অভিযান শেষে ফিরে এলে নূরজাহান তাকে রত্মখচিত একটি তরবারি, ঘোড়া, জিন ও হাতি উপহার দিয়েছিলেন। একইভাবে ১৬১৭ সালে শাহজাহান দাক্ষিণাত্য অভিযান শেষে ফিরে এলে তার সম্মানে ভোজের আয়োজন করা হয় এবং তাকে দামি উপহার প্রদান করা হয়। উপহারের মধ্যে ছিল মুক্তাখচিত একটি কটিবন্দ, রত্মখচিত কাঁধের একটি ব্যাজসহ তরবারি এবং একটি ফুল কাতারা। শাহজাহানের ছেলেমেয়ে, তার হেরেমের মহিলা এমনকি তার দাসী বাদীদেরও উপহার দেয়া হয়েছিল। এ উপলক্ষে নূরজাহান ৩০ হাজার রুপি ব্যয় করেন। বহুবার তিনি তার স্বামী জাহাঙ্গীরকে মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন। একবার তিনি এক বণিকের কাছ থেকে ৬০ হাজার রুপি ব্যয়ে দু’টি বিরাট মুক্তা ক্রয় করেন। বণিক তুরস্ক থেকে এ দু’টি মুক্তা সংগ্রহ করেছিল। নূরজাহান এ দু’টি মুক্তা জাহাঙ্গীরকে উপহার দেন। তার ওজন গ্রহণের একটি অনুষ্ঠানে তিনি আমির ও অভিজাতদের পোশাক উপহার দেন। মমতাজ মহল তার স্বামী শাহজাহানকে পেশকাশ আকারে দামি জিনিস উপহার দিতেন। বলখে শাহজাহানের বিজয় উদযাপনে তার ফুফু শাকুরুন্নিসা বেগম তাকে অভিনন্দন জানাতে আকবরাবাদ থেকে এসেছিলেন। তিনি তাকে ৪ লাখ রুপি মূল্যের লাল উপহার দিয়েছিলেন। ১০৬৬ হিজরিতে এক অনুষ্ঠানে শাহজাহানের উপপত্মী আকবরাবাদি মহল তাকে ৩০ হাজার রুপি মূল্যের একটি হীরার আংটি উপহার দেন। জাহানারা বেগম তার পিতা শাহজাহানসহ অনেককে প্রায়ই উপহার দিতেন। শাহজাহানের ওজন গ্রহণের অনুষ্ঠানে তিনি তাকে ৩১ সারাখ ও ৪০ হাজার রুপি মূল্যের একটি মুক্তা উপহার দিয়েছিলেন। এ উপলক্ষে তিনি গরীবদের মাঝে স্বর্ণ ও রৌপ্য বিলিয়ে দেন। আওরঙ্গজেবের অভিষেকে জাহানারা বেগম ও অন্যরা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। ১০৭০ হিজরিতে চান্দ্র মাসে আওরঙ্গজেবের ওজন গ্রহণ উপলক্ষে জাহানারা বেগম তার কাছে এসে তাকে ২ লাখ ৮০ হাজার রুপি মূল্যের মুক্তা ও ৫টি রুবি উপহার দেন। ১০৭২ হিজরির শাওয়াল মাসে তিনি তার কাছে উপহার হিসাবে দামি রত্ম পাঠিয়েছিলেন।

রাজনীতিতে হেরেমের মহিলাদের প্রভাব

আজকের মতো তখন মহিলারা রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারতেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ না থাকলেও মোগল হেরেমের গুরুত্বপূর্ণ মহিলারা নিজ নিজ গুণে রাজনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমে যার নাম আসে তিনি হলেন ভুবন মোহিনী রূপের অধিকারী সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের। নূরজাহান মোগল রাজনীতিতে এত প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন যে, স্বয়ং স্বামী সম্রাট জাহাঙ্গীর পর্যন্ত তার হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন। জাহাঙ্গীরের পাশাপাশি তার নিজের নামে মুদ্রা চালু করা হয়। শেষ জীবনে জাহাঙ্গীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে নূরজাহানের হাতে প্রশাসনের পুরো ক্ষমতা এসে যায়। তার পিতা মির্জা গিয়াস বেগ মোগল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। ভাই মির্জা আবুল হাসান পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। আবুল হাসান আসফ খানের পুত্র শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শাহজাদা সেলিম পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আকবরের মা হামিদা বানু বেগম হস্তক্ষেপ করেন এবং উভয়ের বিরোধ মীমাংসা করেন। হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম রাজনৈতিক গোলযোগ সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। কামরান মির্জা পিতা সম্রাট বাবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদানের অনুরোধ জানিয়ে হুমায়ুনের কাছে পত্র লিখতে তাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। সম্রাট আকবর তার মা হামিদা বানু বেগমকে দিল্লি প্রদেশের গভর্নর পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন। ১৫৮১ সালে সৎ ভাই মির্জা হাকিমকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ করার ষড়যন্ত্রে জড়িত কুচক্রীদের শায়েস্তা করতে আকবর কাবুল যাত্রা করেন। এসময় তিনি হামিদা বানুকে এ দায়িত্ব দেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দু্*ই স্ত্রী দিলারা বানু বেগম ও উদয়পুরি মহল ছিলেন রাজনীতিতে উচ্চাকাঙ্খী। আওরঙ্গজেব রাজনীতিতে তাদের নাকগলানোর সুযোগ না দিলেও উদয়পুরি মহল তার মৃত্যু নাগাদ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। উদয়পুরি ও কন্যা জিন্নাতুন্নিসার প্রভাবে আওরঙ্গজেব বিদ্রোহী পুত্র কাম বকশসহ বহু লোকের অপরাধ ক্ষমা করেন। ১৬৬৬ সালে বিদ্রোহী মারাঠা নেতা শিবাজি আওরঙ্গজেবের সঙ্গে আগ্রায় সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের পেছনে আওরঙ্গজেবের কন্যা জাহানারার হাত ছিল। আওরঙ্গজেবের আরো দুই কন্যা জেবুন্নিসা ও পাদশাহ বেগম রাজনীতিতে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। জেবুন্নিসার কনিষ্ঠ ভাই মোহাম্মদ আকবর বিদ্রোহ করলে তিনি তাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দেন।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)